উইলিয়াম নকরেক:
বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতি নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে যারা কোটা সুবিধা পায়, তাদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। সম্প্রতি, সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা ৩০% থেকে ৫% এ নামিয়ে আনা হয়েছে, এবং আদিবাসী জনগণ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য মাত্র ১% কোটা রাখা হয়েছে। এটা হয়তো কিছু মানুষের জন্য সঠিক মনে হতে পারে, কিন্তু আদিবাসী জনগণের জন্য এটি কেমন প্রভাব ফেলছে, সেই সত্যটা কি আমরা উপলব্ধি করছি?
আদিবাসী জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম
আমাদের দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতলে বাস করে, তাদের জন্য কোটা কেবল একটি সংখ্যা নয়। এটি তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, তাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা। তারা বহু বছর ধরে অবহেলা, বঞ্চনা এবং প্রান্তিককরণের শিকার। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং জীবিকা অর্জনের সুযোগগুলি সব সময়ই সীমিত। তাদের জন্য কোটা ছিল একটি সুযোগ, একটি পথ যা তাদের মূলধারার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আশায় রেখেছিল।
শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য
আদিবাসী এলাকায় শিক্ষার অবস্থা এখনও খুবই দুর্বল। স্কুলগুলিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব, এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনের প্রতি উপযুক্ত মনোযোগ না দেওয়া—সবই এই সমস্যার অংশ। অনেক আদিবাসী শিশু তাদের মাতৃভাষায় কথা বলে, কিন্তু স্কুলে এসে তাদের বাংলা ভাষায় পড়তে হয়, যা তাদের জন্য কঠিন এবং অপরিচিত। আমরা সবাই জানি, শিক্ষার হাত ধরে জীবনের দরজা খুলে যায়, কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে সেই দরজা প্রায়ই বন্ধই থেকে যায়।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
আদিবাসী জনগণের জন্য অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকা কঠিন। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীরা মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত। আদিবাসীদের বসবাস করা প্রায় বেশিরভাগ গ্রামের যোগাযোগের ব্যবস্থা এখনও অনেক নাজুক, এখনও পাকা হয়নি, অনেক গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা এখনও পৌঁছায়নি। এসব এলাকার মানুষদের জন্য চাকরি বা উন্নতির সুযোগ খুবই সীমিত। এমন পরিস্থিতিতে কোটা ছিল তাদের জন্য একটা আশার আলো, একটা ভরসা। কিন্তু সেই আলোও আজ ম্লান হয়ে আসছে।
কোটা কমানোর প্রভাব
আদিবাসী জনগণের জন্য কোটা ৫% থেকে ১% এ কমিয়ে দেওয়া মানে তাদের জন্য সরকারি চাকরির দরজা আরও সংকুচিত করা। তাদের সংগ্রাম, তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, এবং তাদের উন্নতির পথ সবই যেন আরও কঠিন হয়ে গেল। কোটা ছিল তাদের জন্য সমান সুযোগ পাওয়ার একটা মাধ্যম, কিন্তু সেই সুযোগও আজ ক্ষীণ হয়ে গেছে।
শিক্ষায় বিনিয়োগের প্রয়োজন
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আরও বিনিয়োগ করতে হবে, বিশেষ করে আদিবাসী এলাকাগুলোতে। তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার যে সরকারি নীতি রয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি। যাতে আদিবাসী শিশুরা স্কুলে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারে, যেন তারা নিজেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্যোগ
আমাদের দরকার এমন কিছু উদ্যোগ, যা আদিবাসী জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। তাদের গ্রামে মৌলিক সেবা পৌঁছানো, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা, এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করা—এসব উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের।
উপসংহার
কোটা নিয়ে এই পরিবর্তন হয়তো কোনো একটি সমস্যার সমাধান, কিন্তু আদিবাসী জনগণের জন্য এটি আরও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আদিবাসী জনগণের জন্য পর্যাপ্ত কোটা বজায় রাখা দরকার, যতক্ষণ না তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সমতা অর্জন করতে হলে শুধু কোটার উপর নির্ভর করা যাবে না। আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে, যাতে আদিবাসী জনগণও সমাজের মূলধারার সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যেতে পারে।
আজকের এই পরিবর্তনগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কেবল কোটা নয়, আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। আদিবাসী জনগণের জন্য প্রকৃত ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
Comments