ছেলেবেলা
- Admin
- Jan 16, 2022
- 5 min read
Updated: Feb 4, 2022
কিছুদিন যাবৎ বৃষ্টি পড়বে পড়বে ভাব। আমি খুব আকুল হয়ে অপেক্ষায় আছি কখন সেই বৃষ্টি পড়বে। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। আজকে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। কাক্সিক্ষত বৃষ্টি। খুব ভিজতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু ভেজা হলো না। মায়ের খুব কড়া নিষেধ আছে। যেন কোনোভাবেই ঠান্ডা না লাগে। এই লকডাউনের সময় যেন বাইরেও বের না হই খুব জরুরি কাজ ছাড়া। তবে কয়েকবার অফিসের কাজে বাইরে বের হয়েছিলাম। বার বার কল দিচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করছিলেন, কি খেয়েছি, ফিরেছি কিনা, এখনও কেন ফিরিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।

মাকে চিন্তায় রাখতে কেন জানি আমার খুব ভালোই লাগে। বিশেষ করে আমাকে নিয়ে বা আমার ব্যাপারে যদি চিন্তিত থাকেন তখন খুব উপভোগ করি। মাঝে মাঝেই আমি অনেক সময় ইচ্ছে করেই এটা সেটা বলে মাকে চিন্তিত রাখি। মোবাইলের ওপাড়ে মায়ের চিন্তিত কন্ঠ শুনতে ভালোই লাগে। অনেক সময় ভাবি আর এমন করবো না। কিন্তু কেন জানি মা’কে চিন্তিত রাখতে ভালোই লাগে আমার। বাইরে থেকে ফিরে আসার পর ইচ্ছে করেই আধঘন্টা পরে জানাই। ফিরে এসেছি বললে, ভালোভাবে হাত মুখ ধুয়ে অথবা স্নান করে বিশ্রাম নিতে বলেন। এই লকডাউনের সময় মা’র সাথে যতবার কথা হয়, ততবারই মা স্মরণ করিয়ে দেন, দেখো বাবা আমাদের ছেড়ে অনেকদূরে আছো তাই, খুব সাবধানে থাকবে, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করবে। অসুস্থ্য হলে তো কেউ দেখার নেই তাই নিজেই নিজের যতœ ভালোভাবে নিও। তাই বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে।
১.
তবে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি দেখে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারিনি। ছাতা নিয়ে হাটতে বের হয়ে গেলাম। অন্তত দুধের স্বাদ ঘুলে মেটানো। এই আর কি। বৃষ্টিতে হাঁটছি। ছেলেবেলার সেই দস্যি সময়গুলো খুব মনে পড়ছিলো। ঝড়ের সময় দলবল নিয়ে আম কুড়ানো, দীঘিতে সাঁতরানো। সাঁতরিয়ে এপাড় থেকে ওপাড় যাবার প্রতিযোগীতা। নানার বাড়ন সত্ত্বেও তার গাছের জাম্বুরা পেরে ফুটবল বানিয়ে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে সবুজ ঘাসের উপর খেলাধূলা, চিৎকার চেঁচামেচি। আম অথবা জাম গাছে উঠে বৃষ্টিতেই আম বা জাম খাওয়া। বাড়ি ফিরলে বাবার বকুনি খাওয়া। পিটুনি থেকে বাঁচতে মার পিছনে শাড়ির আঁচলে লুকাতাম। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়ে গেলে দৌড়ে দীঘির ওপাড়ে নানা বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিতাম। বাবা রুদ্ধমূর্তি ধারণ করলে মা আমাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হত। বাবার বকুনি আর পিটুনি খাওয়ার হাত থেকে তখন একমাত্র নানা’ই বাঁচাতে পারত। সেই পরিস্থিতিতে নানা ছাড়া ওই সময় আর কেউ রক্ষা করতে পারত না। বাবার আদেশ ছিল, যেখানেই থাকি বা যাই না কেন, সন্ধ্যায় আজানের আগেই যেন বাড়ি ফিরি। কখনো আজানের পরে ফিরলে বাবা যদি টের পেত, তাহলে সেদিন কপালে শাস্তি জুটত।
২.
যেদিন খুব বৃষ্টি হত, সেদিন খুব করে চাইতাম হেডস্যার যেন স্কুলে না আসে। কারণ বৃষ্টির দিন হেডস্যার বেশি আসতেন না। হেডস্যার আমাদের অঙ্ক পড়াতেন। অঙ্ক না পারলে খুব করে মারতেন অথবা ক্লাসের বাইরে কানধরে দাড় করিয়ে রাখতেন। শুনেছি স্যারের মার খাবার পর ভয়ে অনেকেই দ্বিতীয়বার আর স্কুলের বারান্দা মারাইনি। স্যার আমাকে অনেক ¯েœহ করতেন। একদিন বৃষ্টির দিন তিনি আমাকে নিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়েছিলেন। উনার সেই বিখ্যাত সাইকেলে করে। প্রথমে বুঝতে পারিনি কেন তিনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন। পরে বুঝতে পারি বই আনতে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন। কর্মকর্তাকে বলছিলেন, আপনারা খ্রীষ্টান ধর্মের বই দিচ্ছেন না কেন। আমার স্কুলেও তো খ্রীষ্টান ছাত্রছাত্রী আছে। তাদেরও তো তাদের ধর্মের বই পড়ার অধিকার আছে। যে ছাত্রটি আমার সাথে এসেছে সে খ্রীষ্টান জিজ্ঞেস করে দেখুন। পরের সপ্তাহে স্যার খ্রীষ্টান ধর্মের তিনটা বই নিয়ে এসেছিলেন আমাদের জন্যে। যেহেতু আমরা তিনজনই ছিলাম। খ্রীষ্টানধর্মের কোন শিক্ষক না থাকায় হেডস্যার আমাদের খ্রীষ্টান ধর্মের ক্লাস নিতেন। খুব যতœ নিয়ে পড়াতেন। আমি গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে পাস করার বছরই স্যারও অবসরে চলে গিয়েছিলেন। পরে কয়েকবছর যোগাযোগ ছিল স্যারের সাথে, অনেকসময় রাস্তায় দেখা হত হোস্টেলে যাওয়া আসার পথে। অনেকদিন হেডস্যারের কোন খবর পাইনি। স্যার কোথায় কেমন আছে জানি না। আমি যে গ্রামের স্কুলে পড়েছি, সেই স্কুলে এখন খ্রীষ্টান ধর্ম পড়ানো হয় না, শিক্ষক নেই বলে। ইসলাম ধর্মের বই পড়ানো হয়। এই নিয়ে আমি ৫/৬ বছর আগে একবার কথা বলতে গিয়েছিলাম প্রধান শিক্ষিকার সাথে। উনার উত্তর ছিলো, যেহেতু শিক্ষক নেই তাই পড়ানো হয় না। আর পরীক্ষায় নাম্বারেরও একটা ব্যাপার আছে। তাই তাদেরকে ইসলাম ধর্ম পড়ানো হয়। কিছু মনে করো না। শুনেছি স্যার চলে যাবার পর খ্রীষ্টান যারা ওই স্কুলে পড়েছে, খ্রীষ্টান ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও, তারা ইসলাম ধর্মের বই পড়েই পরীক্ষা দিয়েছে। স্যারের সাথে যেদিন উপজেলায় বই আনতে গিয়েছিলাম সেদিন সেই কথাগুলো খুব বেশি বুঝতে পারিনি। কিন্তু অনেক পড়ে বুঝতে পারি, স্যার কেন সেই কথাগুলো বলেছিলেন। কেন কর্মকর্তার সাথে বইয়ের ব্যাপারে দেনদরবার করেছিলেন।
৩.
ছাতা না থাকায়, বর্ষাকালে বৃষ্টির দিনে বই নিয়ে আসার জন্যে একটি পলিথিন সাথে রাখতাম সব সময়। স্কুল ছুটির পর বৃষ্টি পড়লে বই আর শার্ট পলিথিনে ভরে বুকে চেপে ধরে দৌড়ে বাড়ি ফিরতাম। অনেক সময় কলাপাতা অথবা বড় কঁচুর পাতা ছাতা হিসেবে ব্যবহার করতাম। বন্ধুদেরকে দেখতাম অনেকেই বড় বড় পলিথিনগুলো ছাতা হিসেবে ব্যবহার করত। স্কুলে থাকতে বেসরকারী সংস্থা ওর্য়াল্ড ভিশন থেকে ছাতা পেয়েছিলাম। পরে সেই ছাতায় ব্যবহার করতাম স্কুলে আসা যাওয়ার জন্যে।
একবার তো বৃষ্টিতে ভিজে সেই জ্বর হলো। জ্বর কোনভাবেই ভালো হচ্ছে না। মা বাবা অনেক চিন্তিত। পরে বাবা আমাকে কোলে নিয়ে তার কাকার বাড়ি গেল। বাবার কাকা আমার দাদু কবিরাজ ছিলেন। শুনেছি অনেককেই ওষুধ দিয়ে সুস্থ্য করেছেন। আমাকে নিয়ে যাবার পর, দাদু ওষুধ দিয়েছিলেন। সেই ওষুধ খেয়েই সুস্থ্য হয়েছিলাম। তবে একবারই না, যতদূর মনে পড়ে ছোটবেলায় যতবারই অসুস্থ্য হয়েছি ততবারই দাদুর ওষুধ খেয়ে সুস্থ্য হয়েছি। তবে সেইবার স্কুলে যে বৃত্তি দিত, অনুপস্থিত থাকার জন্যে বৃত্তির অর্ধেক টাকা কেঁটে রেখেছিলো। মন খারাপ করাতে হেডস্যার বলেছিলেন, আর অসুস্থ্য হয়ো না। পরেরবার যখন বৃত্তির টাকা দিবো পুরোটায় দিবো নিয়মিত স্কুলে এসো।
স্কুল ছুটির পর, আমরা বন্ধুরা মিলে চোর পুলিশ খেলতাম। দিয়াশলাইয়ের প্যাকেট কেঁটে চোর পুলিশ খেলার জন্যে কার্ড তৈরি করতাম। অনেকসময় বড় ভাইদের সাথে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। তারা মাছ ধরত, আমরা দাড়িয়ে দেখতাম। বৃষ্টিতে পানি বাড়লে ধানক্ষেতের আইলগুলো পানির নিচে চলে যেত। তখন কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানাতাম। সেটা নিয়েই বন্ধুবান্ধবরা মাছ ধরতে যেতাম জাল নিয়ে। মাছ পেতাম না কিন্তু তাতেই অনেক আনন্দ হত। বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকা হাঁটুসমান পানিতে ধানক্ষেতে হাডুডু খেলতাম বন্ধুরা মিলে। খেলাশেষে নানার দীঘিতে এসে পানিতে ঝাপাঝাপি করতাম, সাঁতরাতাম আর হৈচৈ চেচামেচি তো ছিলোই। নানা দেখে ফেললে লাঠি নিয়ে তাড়া করত আমাদেরকে। পানি থেকে উঠে দৌড়ে পালাতাম।
৩.
বৃষ্টিতে ভিজে আম/জাম কুড়ানো, জাম্বুরা বা কাগজ দিয়ে বল বা নৌকা বানানো, হাডুডু, বৌচি, চাঁদনী রাতে দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাঙ্গুলি, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ইচিং-বিচিং, কানামাছি খেলাগুলো খুব মিস করি। ডাঙ্গুলি খেলতে গিয়ে চারটি দাঁত হারিয়েছিলাম। সেকি বিশ্রী এক অবস্থা ছিলো। বন্ধুরা খুব ক্ষেপাতো। তাদের সাথে খেলতে লজ্জা পেতাম। অনেকেই বলত আর দাঁত গজাবে না। এতে আরও অনেক ভয় পেতাম। কিন্তু ঠিকই দাঁত গজিয়েছিল।
জানি সেই দিনগুলো আর ফিরে পাবো না। রবি ঠাকুরের সেই মত বলতে ইচ্ছে করে "আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি..।" দূরে থেকেও হুমায়ুন আজাদ এর মত বলতে চাই..
“ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।
..ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।..
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো। ”
প্রকাশ: প্রথম আলো ২৯ জুন ২০২০;
Comments