আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানকে সুরক্ষা ও পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন
- Admin
- Jan 16, 2022
- 5 min read
Updated: Feb 4, 2022
জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২০১৯ সালের ১৮তম সেশনে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানকে সুরক্ষা, প্রচার ও পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে জরুরিভাবে জোড় দেয়া হয়েছিল। সারাবিশ্ব থেকে আদিবাসীদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যে রাষ্ট্রগুলোকে জরুরিভাবে আদিবাসীদের ভাষাসহ, তাদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান ব্যবস্থা বা পদ্ধতি সুরক্ষার জন্যে রাষ্ট্রগুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কেননা আদিবাসীরাই জীববৈচিত্র্য, খাদ্য সুরক্ষা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, বিরোধ নিরসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের ৮০% জীববৈচিত্র্য একমাত্র আদিবাসী অঞ্চলগুলোতেই সংরক্ষিত রয়েছে।

আদিবাসীদের চিরাচরিত জ্ঞান মূলত আদিবাসী জীবনযাত্রা বা পরিবেশের মধ্যেই সর্ম্পকিত নয়। এটি বিশ্বের সমস্ত জাতি বা সমাজের জন্যই মূল্যবান। তাদের ঐহিত্যগত জ্ঞানগুলো সুরক্ষার পাশাপাশি পরবর্তি প্রজন্মের কাছে পৌছে দিতে হবে। আদিবাসীদের ভাষা, দক্ষতা, এবং তাদের কৌশলগুলো বিশ্বের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে যা সমসাময়িক সমস্যা সমাধানের একটি প্রয়োজনীয় মডেল পরিবেশন করে।
আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের সময় আদিবাসী অনেক গ্রামগুলোই বিশেষ ঐতিহ্যগত প্রথা বা কৌশল অবলম্বন করেছে। যা তাদের করোনা থেকে রক্ষা করেছে। “পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি পাহাড়ি জাতিসত্তার সবারই লকডাউনের প্রথা রয়েছে (১৯ অক্টোবর ২০২০,প্রথম আলো)”। মহামারির সময় তারা তা মেনে চলে। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেন, ‘এসব প্রথা ও প্রাচীন জ্ঞান মোটেও ফেলনা নয়। এর চর্চা দরকার সরকারিভাবে। এটি আমাদের সার্বিক শিক্ষার জগতে নতুন সংযোজন ঘটাতে পারে।’ এছাড়াও সিলেট বিভাগের ৯০টি খাসিয়া পুঞ্জি করোনামুক্ত ছিল (১১ আগস্ট, ২০২০, প্রথম আলো)। “দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে করোনা সংক্রমণ কম দেখা যাচ্ছে। কিছু এলাকায় প্রান্তিক এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো সংক্রমণই দেখা যায়নি। যেখানে সংক্রমণ দেখা গেছে, সেখানে মৃত্যুর সংখ্যাও খুব কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কোনো জনগোষ্ঠী কীভাবে নিজেদের রক্ষা করল, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি (২৬ জুলাই ২০২০, প্রথম আলো)”। আদিবাসীরা তাদের প্রথাগত জ্ঞান ব্যবহার করেই করোনা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছে। যদিওবা করোনার প্রকোপে তাদের জীবনে দৈনন্দিন ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে।
আদিবাসীদের ভাষা বা তাদের জ্ঞানগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংরক্ষণ করা খুব জরুরি। যার মধ্যে রয়েছে তাদের গল্প, গান, মিথ, লোককাহিনী এবং প্রবাদ। এছাড়াও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আচার, জনগোষ্ঠীর প্রথাগত আইন, স্থানীয় ভাষা, নিজস্ব কৃষি ব্যবস্থা, শিকার ও মাছ ধরা অনুশীলন, বনায়ন এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। আদিবাসীদের প্রচলিত এ জ্ঞান, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। বর্তমান সময়ে বিশ্ব ও আমাদের দেশ যে সংকট মোকাবেলা করছে তার থেকে উত্তরণে আদিবাসীদের প্রথাগত জ্ঞান অনেক সহায়তা করতে পারে বলে অনেক গবেষকরাই বিশ্বাস করেন। জলবায়ু পরিবর্তন বা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সারা বিশ্বে আদিবাসীরা জনসংখ্যার ৫% হয়েও তাদের অঞ্চলে ৮০ ভাগ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে তা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
তারপরও এইদেশের আদিবাসীদের উন্নয়নের নামে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে হয়। বিভিন্ন শোষণ লাঞ্চণা বঞ্চনার শিকার হতে হয়। আজও একজন আদিবাসী তরুণকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতি, এবং তাদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি রক্ষার জন্যে রাজপথে দাড়াতে হয়, আন্দোলন করতে হয়। বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়ে বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠী পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ ও পর্যটনের নামে তাদের ঐহিত্যগত ও প্রথাগত ভূমি কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ জানিয়েছে (ডেইলি স্টার, নভেম্বর ০৮, ২০২০)। ঞযব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং ঈড়সসরংংরড়হ (ঈঐঞঈ) এই কন্সট্রাকসন বন্ধ করতে সুপারিশ করেছে। এর আগে কাপরুপাড়া, দোলাপাড়া, এরাপাড়া এবং চিম্বুক পাহাড়ে বসবাসকারী ¤্রােদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে এই হোটেল তৈরি বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীর অফিস বরাবর পিটিশন জমা দিয়েছিল বলে জানা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রেংয়ং ¤্রাে, ৮ নভেম্বর প্রতিবাদী সমাবেশে বলেছিলেন, “নীলগিরি কোনদিন আমাদের নাম ছিল না, চন্দ্রপাহাড় কোনদিন আমরা চিনি না। আমরা 'শোং নাম হুং' নামে চিনেছি, আমরা 'তেংপ্লং চূট' নামে চিনেছি। এই 'শোং নাম হুং' কিভাবে চন্দ্রপাহাড় হয়ে যায়, এই 'তেংপ্লং চূট' কিভাবে নীলগিরি হয়ে যায়? এই জীবন নগর কিভাবে তোমাদের জীবন নগর হয়ে যায়?”
রেংয়ং আরও বলেন, “এই ভূমি, এই মাটির প্রত্যেকটা ইঞ্চি আমাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি। এই চিম্বুক পাহাড়ে একটাও প্রাইমারি স্কুল নেই, একটাও সরকারি হাই-স্কুল নেই। কোন মুখে আপনারা এখানে উন্নয়নের কথা বলেন, কোন মুখে বলেন আমরা ¤্রােদের জন্য উন্নয়ন করছি, ¤্রােদের উন্নতির জন্য পর্যটন করছি। আপনাদের ভিটেমাটিতে যদি কোন ¤্রাে জনগোষ্ঠী গিয়ে জায়গা দখল করে, আপনাদের জায়গায় গিয়ে যদি আমরা বলতাম - এটা আমদের পর্যটন স্পট, আপনাদের কেমন লাগত একবার নিজের বুকে হাত রেখে প্রশ্ন করুন। যেদিন আপনারা এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবেন, সেদিন আমাদের প্রশ্নও বুঝতে পারবেন।” বুকে কতটুকু কষ্ট জমা থাকলে এমন কথা বলা যায়! আদিবাসী উচ্ছেদের এটি একটি মাত্র উদাহরণ। প্রতিনিয়তই আদিবাসীরা তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। এইসব কারণেই আদিবাসীরা বরাবরই সরকারী উন্নয়নের ভয় পায়, আতঙ্কগ্রস্থ হয়। কেননা এই উন্নয়নের নামে তাদেও ঐতিহ্য ও প্রথাগত ভূমি হারাতে হয়েছে বা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে (সিএইচটি) চিম্বুক-থানচি রুটে একটি পাঁচতারা বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণের কারণে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের ঐতিহ্য ও প্রথাগত জমি থেকে ¤্রাে জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক উচ্ছেদে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
“ভূয়া দলিলে পানজুম দখল, অস্তিত্ব সংকটে খাসিয়া পরিবার (ডেইলি স্টারে ৫ নভেম্বর ২০২০)। খাসিয়া পরিবারের প্রথাগত জমি জোরপূর্বক দখল করে করেছে একটি চক্র এবং জুমেও কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না বলে জানা যায়। একমাত্র আয়ের উৎস এই পানজুমটি দিয়ে পরিবারের কর্তার ক্যান্সার চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ চালাতো ওই পরিবার। যার দুটিই এখন সংকটের মধ্যে আছে।” কিছুদিন আগে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের প্যাগামারী গ্রামের বাসন্তী রেমার ৪০ শতাংশ কলাবাগান কেঁটে দিয়েছিলো বন কর্মকর্তারা। এই কারণে মধুপুরের আদিবাসী বাঙালী সকলে আন্দোলনে নেমেছিলেন। মিডিয়ার বদৌলতে জানা যায় শুধুমাত্র বাসন্তী রেমার ফসলি জমিই নস্ট করেনি। অরণখোলা ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের ১০টি মান্দি পরিবারের ৫ একর জমির আনারস, পেঁপে, আদা, হলুদ, কলা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এমন আরও অসংখ্য খবর আমাদের কাছে আসে। যেগুলো মিডিয়াতে আসে না।
আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্য ও প্রথাগত ভূমি হারিয়ে অস্তিত¦্য সংকটে পড়েছে। ভূমি হারানোর সাথে পাল্লা দিয়ে দিন দিন আদিবাসীদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও সংস্কৃতি সুরক্ষা, পুনরুজ্জীবিত এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে তাদের ঐতিহ্য ও প্রথাগত ভূমি রক্ষা করতে হবে। কেননা এই ভূমিকে কেন্দ্র করেই আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই বন ও ভূমির সঙ্গেই আদিবাসীদের নিবিড় সম্পর্ক। আদিবাসীদের কাছে বন এবং ভূমি অতি পবিত্র। ভূমি এবং আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বৈশ্বিক পর্যায়ে আদিবাসীদের লেটিসিয়া ঘোষণাপত্রটির কয়েকটি লাইন বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো- “সকল মানুষের আগমন ঘটেছে বন থেকে, ভূমি থেকে। বন মরে গেলে মানুষ মরে যায়। আমাদের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার, একে মমতা-ভালোবাসা দিয়ে যতœ করার। যখন এ প্রকৃতির কোনো একটি অংশকে ধ্বংস করা হয়, তখন সকল ভারসাম্য লন্ডভন্ড হয়ে যায়। যখন বনের শেষ বৃক্ষ কেঁটে ফেলা হবে, যখন শেষ নদীটি শুকিয়ে যাবে, তখন মানুষ শিখবে যে সোনা ও রুপা খেয়ে জীবন বাঁচে না। সঠিক ও নির্লোভভাবে প্রকৃতিকে, বন ও ভূমিকে ব্যবহার করার ভার আমরা পেয়েছি পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে, যারা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একে রক্ষার ভার আমাদের দিয়ে গেছেন।”
আমরা যদি ধরিত্রী মাতাকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে চাই এবং আগামী প্রজন্মের জন্যে রেখে যেতে চাই, তাহলে অবশ্যই আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানকে সুরক্ষা ও পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সভাপতি অ্যানি নুরগাম ১৮তম সেশনে বলেছিলেন, “আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, ভাষা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিচালনার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং সম্মানিত হয়। কেবল সরকার কর্তৃক নয়, দেশের প্রতিটি নাগরিক দ্বারা।” আমরা যদি সত্যিই আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানকে সুরক্ষা ও পুনরুজ্জীবিত চায় তাহলে অবশ্যই মহাশ্বেতা দেবীর মত বলতে হবে “ভালোবাসা, প্রচন্ড নিদারুন ভালোবাসাই পারে, এ কাজে এখনও আমাদের ব্রতী করতে...”।
প্রকাশিতঃ Click here
Comments